ঊর্ধ্বমুখী বাজারদর বারবার কেন? ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে 'Cut your Coat According to Your Cloth' যার বাংলা অর্থ ‘আয় বুঝে ব্যয় করো।’ প্রবাদটি অতীব সত্য এবং যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে রয়েছি যে, এই প্রবাদটি অসার প্রমাণিত হতে আর দেরি নেই। ‘আয়’ নামক সোনার বস্ত্রটি ব্যয়ের তুলনায় এত স্বল্পদৈর্ঘ্যরে যে সেটি দিয়ে পুরো শরীর ঢাকা দূরে থাকুক, লজ্জা নিবারণ করাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে এই ব্যয় বাড়ার মূল কারণ হলো, ‘ঊর্ধ্বমুখী বাজার দর!’ মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদা- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থান। এই পাঁচটি অতি অত্যাবশক বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি জিনিসের মূল্য কয়েক বছরে এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সাধারণ মানুষকে দুবেলা মোটা চালের ভাত খেতেও কড়ায়গণ্ডায় মাস কাবারের হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। যেখানে প্রতিটি জিনিসের মূল্য আকাশছোঁয়া সেখানে মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করবে তো কিসে? একটি প্রয়োজন ছেঁটে বিকল্প কিছু করবে সে উপায়ও নেই। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসই প্রতিদিন পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
মাছ-মাংস বাদ দিলাম। নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন মা যদি সন্তানের প্লেটে দুটো গরমভাতের সঙ্গে সামান্য আলুভর্তা, ডিম ভাজা দিতে চান তা হলে কী অবস্থা দাঁড়ায় হিসাব করে দেখুন। মোটা ইরির চাল কিনতে গেলেও কেজিতে পড়বে ৪৮-৫০ টাকা, গরিবের ভাত-আলুর দাম বেড়ে হয়েছে ৩৬-৪০ টাকা, আলুভর্তায় দুটো কাঁচামরিচ ভেঙে দেবেন? গুনতে হচ্ছে কেজিতে ১৪০-২৪০ টাকা, গত কয়েকদিনে ডিম নিয়ে যে তেলেসমাতি হয়ে গেল তাতে করে তিনি এখন দরিদ্রের হেঁসেল ছেড়ে ধনীর টেবিলেই কেবল মানানসই। কোনোমতে এক হালি ডিম কিনলেন দাম দেবেন ৪৬-৫৩ টাকা। এখন ডিম ভাজতে তো তেল লাগবে? তেলের দাম কত? সেটিও জেনে নিন। বর্তমানে বাজার দর অনুযায়ী সয়াবিন তেলের লিটার ১৭০-১৭৫ টাকা। ডিমে দুটো পেঁয়াজকুচি না দিয়ে একটাই দিন। কিন্তু পেঁয়াজের গায়ে কাঁটা। ধরতে গেলেই হুল ফুটিয়ে দেবে। পেঁয়াজের কেজি ৮০-৮৫ টাকা। আলুভর্তার সঙ্গে ডিম না খেতে পারেন এক বাটি ডাল তো চলতে পারে। কিন্তু বিত্তহীনের প্রোটিনখ্যাত ডালের দামেও আগুন। এক কেজি মসুর ডালের দাম ১৩৫-১৫০ টাকা।
থামুন মশায়, ওপরের যে দরদাম কষে দিলাম সেটিও কিন্তু আসল বাজারদর নয়; বরং ‘ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’ কর্তৃক দেওয়া বাজারদর। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও পাইকারি বলেন আর খুচরা বলেন ব্যবসায়ীরা সেটা মানছে কোথায়? বরং যার যখন ইচ্ছে যেভাবে পারছেন সাধারণ ক্রেতাদের ঘাড় মটকাচ্ছেন।
এক সময় যখন তিনবেলা ভাত খাওয়া ছিল অবস্থাপন্ন মানুষের আইডেন্টিটি তখন দেখেছি ভাতে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য গরিব মানুষরা দুবেলা আটার রুটি খেত। সেই আটা বহুকাল ধরে ধনীর অধিকারে। বর্তমানে আটার কেজি ৫৫-৬০ টাকা। শাকসবজিও আজকাল বিলাসী খাবার। বেগুনের কেজি ৫৫-৭০ টাকা, পটোলের কেজি চলছে ৬০-৭০ টাকা। এভাবে প্রতিটি সবজি সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মধ্যে দু-পাঁচ টাকা নেমে এলেও পরদিন আরও পাঁচ-দশ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। মোট কথা পুরোটাই তুঘলকি কাণ্ড।
এ দেশের আশি ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাদের স্বল্পআয়ে কোনোরকম গ্রাসাচ্ছাদন করে চলে। কিন্তু বর্তমান অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি কপালের ভাঁজের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একজনের আয়ে চলা সংসারের অবস্থা আরও বেহাল। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যদি সন্তানের মুখে দুমুঠো অন্ন জোগাতে না পারে তা হলে তার মতো দুঃখের কথা আর কী হতে পারে! ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা সন্তানের প্রতি এই আশীর্বাদ বাণী আমরা আর উচ্চারণ করার সাহস পাই না বাজারে যখন লিটারপ্রতি দুধ ৮০-১০০ টাকা।
গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ আজ কেবলই বইয়ের পাতায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে দুবেলা মাছ খাওয়া চরম বিলাসিতা। অতিথি আপ্যায়নের বা সন্তানের আবদার মেটাতে যে ব্রয়লার মুরগি ভরসা ছিল তার দাম বেড়ে ১৬৫-১৭০ টাকা কেজি। গরু-খাসি নিম্নবিত্তের আওতা থেকে বহু আগেই বেরিয়ে গেছে। গরুর মাংসের কেজি ৭৫০-৭৮০, খাসির মাংস ১০০০-১১০০ টাকা। মাসে ১১০০ টাকা দিয়ে এক কেজি খাসির মাংস খাবেন নাকি বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছেন না বলে কেটে দেওয়া লাইন জোড়া লাগাবেন?
দরদাম জেনেই বা কী হবে, সমস্যা সমাধানের রাস্তা খোঁজাটাই জরুরি। সবার জানা কথা, চাহিদার তুলনায় জোগান কম হলেই বাজারে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল সব সময় জানাচ্ছে উৎপাদনের ঘাটতি নেই তাই জোগানের ঘাটতিও নেই। উদ্বেগের বিষয় হলো, তা হলে ঘাটতি কোথায়? এই সমস্যা কি শুধু অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর ষড়যন্ত্র নাকি যথাযথ নজরদারির অভাব?
গলদ যেখানেই থাকুক এর গোড়া খুঁজে আশু পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি। করোনার কারণে বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে টালমাটাল। তার ওপর রয়েছে আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঝড়-ঝঞ্ঝা-খরা! কারণ যাই হোক, নিত্য নিত্য মূল্যবৃদ্ধি আমাদের বাজারের ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এই ট্র্যাডিশনকে রুখতে হবে। এমন নয়- কৃষক ফসল ফলাতে আলসেমি করছেন। বরং বাজারে যে এত দরে জিনিসপাতি বিক্রি হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা তার খবরই রাখেন না। আর খবর জানলেও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে স্বল্প দামেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। পচনশীল পণ্য স্টকে রাখার উপায়ও নেই। ফলত কৃষকের ভাগ্যের পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি! যারা অর্থ খরচ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পণ্য উৎপাদন করছে তারাই সব থেকে কম লাভবান হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। যার কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনে অনেক কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর প্রভাব পড়ছে বাজারে এবং পরিশেষে সাধারণের পকেট থেকে দৈনন্দিন জীবনে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবমূল্য বৃদ্ধি আমাদের পারিবারিক তো বটেই, সামাজিক জাতীয় জীবনের দুষ্টু রাহু। বাজারের চাহিদার সঙ্গে জোগানের যদি সামঞ্জস্য না থাকে তা হলে বাজারদরে আগুন লাগবেই, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত হারে বাড়বে এবং বাড়ছেও। সাধারণ মানুষের জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বা পড়বে। কৃচ্ছ্রসাধন করতে করতে একদিকে যেমন এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ অপুষ্টির শিকার হবে, অন্যদিকে অভাবের তীব্রতায় মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত একটি জাতিতে পরিণত হবে। মানুষ বাড়ছে, বাড়বেই এটাই নিয়ম। কিন্তু ফল কী? কবির ভাষায়,
‘অভাব শুধু নাই মানুষের/চাই কত মণ, চাই কত সের,/আন্ডা চাও বাচ্চা চাও/ জোয়ানে/ বুড়ো-আসল ফাও/ চাহিদা নাই মানুষগুলোর।/ কেবলি তার পড়ছে বাজার।’
মানুষ যেন নানাবিধ সমস্যার ঘেরাটোপে আটকে পড়া পড়তি বাজারের বাড়তি মালসামান! বাজারের সব জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের দাম কমছে। প্যানডেমিক সময়ে বা পরবর্তীকালে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন বা ব্যবসায় লোকসান গুনে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের ছোটাছুটি বেড়েছে, এই সুযোগে স্বল্প বেতনে তাদের কাজে লাগাচ্ছে বড় বড় কোম্পানি। একদিকে যখন মানুষের দাম পড়তি, অন্যদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি সমাজে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে রাষ্ট্র, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থানে দায়িত্ব রয়েছে। প্রশ্ন হলো সেই দায়িত্ব কি আদৌ পালিত হচ্ছে বা হয়? এই প্রশ্নের জবাবদিহিতা সংশ্লিষ্ট সব মহল যতদিন দিতে বাধ্য না হবে ততদিন পর্যন্ত বাজারদরে বিশাল বিস্ময়বোধক চিহ্ন বিরাজ করবেই। তেমনি সাধারণ মানুষ এই সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে একটু দমের আশায় হাঁসফাঁস করতে থাকবে। এই দুটোর কোনোটির ফলই আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা জাতীয় জীবনের জন্য শুভ নয়।
ম্যারিনা নাসরীন : কথাসাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক, ময়মনসিংহ কলেজ
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ আমিনুল ইসলাম রুদ্র, সহ-সম্পাদক: সুব্রত দেবনাথ, নির্বাহী সম্পাদক : জায়েদ হোসাইন লাকী, বার্তা সম্পাদক : শহীদুর রহমান জুয়েল। ঢাকা-১২৩০ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।