টাঙ্গাইলের শতাব্দীর প্রাচীন কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ মাঠে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে মিনি ট্রাকস্ট্যান্ড। এ ছাড়া ট্রান্সপোর্ট ট্রাকের মালামালও নামানো হচ্ছে এখানে। ১৯০৫ সালে ৬ একর জায়গার উপর স্থাপিত ১১৮ বছরের পুরাতন এই ঈদগাহ মাঠে আরও বসেছে চায়ের দোকান, যৌনশক্তি বর্ধক শরবতের দোকান, ফাস্টফুড, সিঙ্গারা-পুরির দোকানসহ বাঁশের বাজার।
কেন্দ্রীয় ঈদগাহ জায়গাটি ১ নং খাস খতিয়ান হওয়ায় এর মালিক জেলা প্রশাসন। এই কেন্দ্রীয় ঈদগাহটি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে আছে টাঙ্গাইল পৌরসভা। সরেজমিনে দেখা যায়, ৬ একর জায়গার উপর স্থাপিত এই কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে প্রবেশের মুল ফটকের কাছে উত্তর দিকে বাউন্ডারি দেওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ৮টি চায়ের দোকান, একটি যৌনশক্তি বর্ধক শরবতের দোকান, ২টি ফাস্টফুড, ২টি সিঙ্গারা-পুরির দোকান।
মাঠের মাঝখানে রাখা হয়েছে শত-শত মিনি ট্রাক। মিনিট্রাক স্ট্যান্ডের চাঁদা কালেকশনের জন্য তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী ছাউনি। অস্থায়ী ছাউনিতে বসে দুজন স্টাফ রিসিটের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করছে প্রতিটি মিনিট্রাক থেকে। এর পশ্চিম দিকে শিশু-কিশোরদের খেলার অংশে বসেছে ট্রান্সপোর্ট ট্রাক স্ট্যান্ড। এখানে বড়-বড় কাভার্ড ভ্যান থেকে নামানো হচ্ছে হরেক রকমের পণ্য। মাঠে খেলতে আসা বিভিন্ন এলাকার শিশু-কিশোরদের ব্যাট বল হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোন উপায় যেন নেই তাদের। এই মাঠকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ফিটনেস ক্লাব। তাদের শরীর পরিচর্যা ও খেলাধুলার জায়গায় আর অবশিষ্ট নেই। মাঠের পূর্ব অংশে পার্কের বাজারের দেয়াল ঘেষে রাখা হয়েছে টাঙ্গাইল পৌরসভার বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য ও ময়লা। বৃষ্টি হওয়ার ফলে এই ময়লা আর্বজনা থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ।
এসময় পার্ক বাজারের চারজন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে এইস্থানে পার্ক বাজারের যাবতীয় বর্জ্য এনে ফেলতে দেখা যায়। এই মাঠের সর্ব দক্ষিন পাশের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের একমাত্র বাঁশের বাজার। পুরো দক্ষিন অংশ জুড়েই রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাঁশ। এছাড়াও দক্ষিন অংশের সীমানা প্রাচীরের পাশে অবস্থিত শহরের অন্যতম পয়:নিস্কাশন ড্রেনটি ময়লা আর্বজনায় পরিপুর্ন হয়ে রয়েছে। ফলে পৌর এলাকার পশ্চিম অংশে পয়:নিস্কাশন মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বাঁশ বাজারের বিভিন্ন অংশে উঠতি বয়সী শিশু-কিশোরদের ধুমপানে ব্যস্ত দেখা যায়। সন্ধ্যার পর চলে বিভিন্ন ধরনের নেশার কারবার।
ঈদগাহ মাঠে মালবাহী ভারী ট্রাক চলাচলের ফলে মাঠটি মাটি-কাঁদায় একাকার হয়ে গেছে। এতে করে মাঠটি সম্পুর্ন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মাঠের বৃষ্টির পানি বের হওয়ার একমাত্র ড্রেনটি পৌরসভার ফেলা ময়লা আর্বজনায় বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পুরো মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চায়ের প্লাস্টিকের কাপ, চা তৈরীর জন্য ব্যবহৃত পাতি, ফাস্টফুডের দোকানে ব্যবহার করা ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের প্লেট,গ্লাস, পলিথিন ও ব্যবহার করা টিস্যু পেপার সহ অসংখ্য বর্জ্য।
এছাড়া ঈদগাহ মাঠের পূর্বাংশ জুড়ে প্রতিদিন সকালে বসে সব্জির বাজার। সবজির বাজারের বহুবিধ সব্জির পরিত্যাক্ত অংশ পুরো মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এই মাঠটিতে বছরে মুসলমানদের দুটি সর্ব-বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আযহার নামাজ আদায় করা হয়। এছাড়া প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে ফেব্রয়ারী মাস পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন ধরনের ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে মাঠের যে অবস্থা তাতে ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আযহা নামাজসহ বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠনের আয়োজন করা সম্ভব হবে না বলে অনেকের ধারণা।
ঈদগাহ মাঠে ক্রিকেট খেলতে আসা টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সোয়েব, ছায়েম, মেহেদী, তমাল, আবীর, শাহীন জানায়, প্রতি শুক্রবার তাদের এখানে নিয়ে আসা হয় খেলাধুলা করার জন্য। কিন্তু এবার এসে তারা দেখতে পায় তাদের খেলার জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ট্রাক রাখা হয়েছে। সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা খেলার সুযোগ পেলেও অবৈধভাবে ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে তোলায় গত বেশ কয়েক শুক্রবার যাবত খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
ঈদগাহ কেন্দ্রীক গড়ে ওঠা এভারগ্রীন ফিটনেস ক্লাবের সমন্বয়ক সৈয়দ নাজমুল হোসেন জানান, ঈদগাহ মাঠকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন সকালে ৮ থেকে ৯ টি ফিটনেস ক্লাবের প্রায় শতাধিক সদস্য এখানে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করে। এতগুলো ফিটনেস ক্লাবের জন্য ঈদগাহ মাঠ এমনেতেই অপ্রতুল্য। মরার উপর খাঁড়ার গাঁয়ের মতো এখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড। ফলে সকাল বেলায় খেলতে আসা বিভিন্ন বয়সের শিশু-কিশোরসহ স্বাস্থ্য সচেতন লোকদের জন্য এটা একটা বিরাট সমস্যার কারন হয়ে দাড়িয়েছে। এই মাঠে সকল সক্রিয় ফিটনেস ক্লাবের পক্ষ থেকে আমি অবিলম্বে ট্রাক স্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করে ঈদগাহ মাঠের পবিত্রতা রক্ষার জোর দাবি জানাচ্ছি। টাঙ্গাইলের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে কথা হয় মো. রাসেল খান, মো. আনিছুর রহমান, আব্দুল লতিফ, শরিফুল ইসলাম ভুইয়া, মশিউর রহমান, হাদি উজ্জামান সোহেল, ছাদেক ইসলাম, জামিল সিদ্দিকী, আব্দুল মজিদ সুমন, আনোয়ার হোসেন, হিমেল, স্বপনসহ আরও বেশ কয়েকজনের সাথে।
তারা ক্ষোভের সাথে জানায়, মুসলমানদের জন্য ঈদগাহ একটি পবিত্র স্থান। বছরে ২ বার এখানে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে জড়ো হয় ঈদের নামাজ আদায় করতে। গত কয়েক বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে চায়ের দোকান, যৌন শক্তি বর্ধক শরবতের দোকান,ফাস্টফডসহ পুরি-সিঙ্গারার দোকান। যেটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। সেপ্টেম্বর মাস থেকে এখানে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে মিনি ট্রাকস্ট্যান্ড ও ট্রান্সপোট ট্রাকের মালামাল নামানোর স্থান। ভারী ট্রাক চলাচলের ফলে ইতোমধ্যে ঈদগাঁ মাঠ অসমতল হয়ে গেছে।
তারা আরও জানায়, ঈদগাহ মাঠটি সংস্কার করা হবে বলে বার বার বলা হচ্ছে। মূলত কোন কাজের কাজও হচ্ছেনা। আমরা অবিলম্বে এই কেন্দ্রীয় ঈদগা মাঠ থেকে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডসহ সকল ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ চাই। এছাড়া দ্রুত মাঠটি সংস্কার করার জোর দাবি জানান তারা। এই মাঠে গড়ে উঠা মিনি ট্রাকস্ট্যান্ডের নেতৃত্বে থাকা মো. হোসেন আলি ও রুবেল জানায়, স্টেডিয়াম পুকুরের সামনে থেকে ট্রাক স্ট্যান্ডটি উচ্ছেদ করার পর আমরা পৌর মেয়রের সাথে কথা বলে অস্থায়ীভাবে ঈদগাহ ট্রাক স্ট্যান্ডটি স্থাপন করা হয়েছে।
কিভাবে এখানে ট্রাক স্ট্যান্ড হলো জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের স্থানীয় নেতা বাবলা সাহা বিস্তারিত জানে আমরা কিছু বলতে পারবো না। টাঙ্গাইল পৌর মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর জানান,কমিশনার গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট সুন্দর ভাবে করার স্বার্থে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পুকুরের সামনে থেকে ট্রাক স্ট্যান্ডটি সরিয়ে ঈদগাহ মাঠে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই ঈদগাহ মাঠে ট্রাক স্ট্যান্ডসহ কোন ধরনের দোকান করার সুযোগ নেই।
আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই টাঙ্গাইল পৌরসভা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের সংস্কারের কাজ শুরু করবে। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মোঃ কায়ছারুল ইসলাম জানান, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে ট্রাক স্ট্যান্ড করার কোন ধরনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদি কেউ বিনা অনুমতিতে ট্রাক স্ট্যান্ড করে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ছানোয়ার হোসেন জানান, বিষয়টির সম্পর্কে আমি অবগত নই। এই ঈদগাহ মাঠটি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব টাঙ্গাইল পৌরসভার। তারপরও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ আমিনুল ইসলাম রুদ্র, সহ-সম্পাদক: সুব্রত দেবনাথ, নির্বাহী সম্পাদক : জায়েদ হোসাইন লাকী, বার্তা সম্পাদক : শহীদুর রহমান জুয়েল। ঢাকা-১২৩০ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।