দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার নতুন ও বয়সে নবীন প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে যতটা সম্ভব পুরনো মুখ বদলে নতুন মুখ আনার কৌশল নিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ৩০০ আসনের মধ্যে কমবেশি ১০০ আসনে নৌকার মাঝি পরিবর্তন করা হয়েছে।
মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্যরা জানান, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে একটি আসনে একজন সংসদ সদস্যকে একাধিকবার নির্বাচিত হতে দেখা নেতাকর্মীদের কাছে একঘেয়েমির বিষয়। স্থানীয় জনগণও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয় না। এ ছাড়া নতুন যেসব প্রার্থীকে মনোনয়ন বোর্ড বেছে নিয়েছে তারা সবাই বর্তমান সংসদ সদস্যদের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় বলে জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্যরা জানান, নির্বাচন উৎসবমুখর করার পাশাপাশি নেতাকর্মী ও ভোটারদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নতুন মুখকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
যেসব আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগ আসনে দলের নতুন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সে ক্ষেত্রে বাদ পড়ছেন বেশ কয়েকজন প্রবীণ সংসদ সদস্য। এ ছাড়া বর্তমান সংসদের বেশ কয়েকজন সদস্যের মৃত্যুতে উপনির্বাচন করতে হয়েছে। তাই এবার কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের না রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের তিন সদস্য বলেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ ও বয়সী বর্তমান সংসদ সদস্যকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এবার মনোনয়নের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব পারিবারিক বলয় থেকে বের করে আনা হচ্ছে সংসদ সদস্য পদটি। বাবা সংসদ সদস্য, তাই ছেলে বা মেয়েকে মনোনয়ন দেওয়ার পুরনো ধারা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টাও করা হয়েছে।
মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্যরা আরও বলেন, বর্তমান সংসদের তরুণ অনেক সদস্যও বাদ পড়েছেন। দলকে দুর্বল করা, জনগণের সেবক হওয়ার দায়িত্ব নিয়ে জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করা এমন বেশ কয়েকজন তরুণ সংসদ সদস্যকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনগণ ও নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন এমন সংসদ সদস্যও আছেন বাদের তালিকায়।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবারে মনোনয়নে একাধিক চমকও রয়েছে। ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে কুড়িগ্রামের একটি আসন থেকে মনোনয়ন দিয়ে চমক রাখা হয়েছে। এবারের সংসদ নির্বাচনে চমক হিসেবে আসতে পারেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের নেতাদের ছেড়ে দেওয়া একাধিক আসন এবার আওয়ামী লীগ রেখে দিতে চায়। এর মধ্যে ঢাকায় ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননের আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিমকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের আসনটিও এবার আওয়ামী লীগ নিতে চায়। সেখানে প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকনকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঢাকার আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য সাদেক খানের আসনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাদেক খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে। তা ছাড়া, ফরিদপুর-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা-১০ আসনে চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। মাগুরায় ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
মনোনয়ন বোর্ডের আরেক সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্য থেকে অন্তত পাঁচজন নেতাকে নতুন করে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইলে দুটি আসনে পরিবর্তন আসছে। সেখানে একটিতে পেশাজীবী সংগঠনের নেতা ডা. কামরুল হাসান ও মামুনুর রশীদ মনোনয়ন পাচ্ছেন। জামালপুর একটি আসনে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ও আরেকটি আসনে মারূফা আক্তার পপিকে বেছে নিয়েছে মনোনয়ন বোর্ড। নেত্রকোনায় দুটি আসনে বর্তমান দুই সংসদ সদস্য বাদ পড়েছেন। সেখানে একটিতে মোসতাক আহমেদ রূহী ও আহমেদ হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফরিদপুর-৪ কাজী জাফর উল্যাহ আবার মনোনয়ন পেয়েছেন। সিরাজগঞ্জে বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাতকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
নতুন প্রার্থীদের মধ্যে আরও আছেন চট্টগ্রাম-১ আসনে মাহাবুবুর রহমান রূহেল, চট্টগ্রাম-৫ এম এ সালাম, ঢাকা-১৪ যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা-৪ সানজিদা খানম, চট্টগ্রাম-৪ এস এম আল মামুন, চাঁদপুর-২ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, ফরিদপুর-৩ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক, রংপুর-৫ রাশেক রহমান, ঢাকা-৫ সজল মোল্লা ঢাকা-৭ সোলায়মান সেলিম, কক্সবাজার-১ সালাহ উদ্দিন, চাঁদপুর-১ সেলিম মাহমুদ, সুনামগঞ্জ-১ রণজিৎ সরকার, সুনামগঞ্জ-২ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, সুনামগঞ্জ-৪ পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মৌলভীবাজার-২ শফিউল ইসলাম চৌধুরী নাদেল, চট্টগ্রাম-২ খাদিজাতুল আনোয়ার, ঢাকা-১১ ওয়াকিল উদ্দীন। এ ছাড়া সিলেট-৫ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন, সিলেট-২ আসনে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী, বরিশালে পঙ্কজ দেবনাথের আসনে শাম্মী আহম্মেদ, শাহে আলমের আসনে তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস মনোনয়ন পেয়েছেন।
আজ রবিবার বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে চূড়ান্ত হওয়া প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আগে সকালে মনোনয়নপ্রত্যাশী সব প্রার্থীকে গণভবনে ডেকে কথা বলবেন দলীয় প্রধান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
দশম জাতীয় সংসদের ৪৮ জন এমপি একাদশ জাতীয় সংসদে দলীয় মনোনয়ন পাননি। আর নবম সংসদের ৬৩ জন বাদ পড়ে বিএনপিবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনে। এর মধ্যে কয়েকটি আসনে জাতীয় পার্টি ও ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের ছেড়ে দেয়।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় :
আজ সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দেবেন। সব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে একসঙ্গে ডেকে মূলত মনোনয়ন যাকেই দেওয়া হোক না কেন নৌকার পক্ষে সবাই যেন একসঙ্গে কাজ করেন, সেই অঙ্গীকার নেবেন শেখ হাসিনা।
সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে গঠিত দলের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সব সদস্য এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সব প্রার্থীকে (জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মনোনয়নপত্রের রিসিভ কপি, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইন ফরমের ফটোকপিসহ) যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত শনি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে ৩৩৬২টি। এতে দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
আর দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বৃহস্পতিবার থেকে সংসদীয় দলের বৈঠক হয়। প্রথম দুই দিনে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। সেখানে সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দেবেন তিনি।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ আমিনুল ইসলাম রুদ্র, সহ-সম্পাদক: সুব্রত দেবনাথ, নির্বাহী সম্পাদক : জায়েদ হোসাইন লাকী, বার্তা সম্পাদক : শহীদুর রহমান জুয়েল। ঢাকা-১২৩০ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।