ওমরি কাজা বা জীবনের সকল কাজা নামাজ আদায় করতে হবে, নাকি তাওবা করলেই সব মাফ হয়ে যাবে— এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে। কারো কারো বদ্ধমূল ধারণা- তাওবা করলে যেহেতু পরের হক ছাড়া আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন, তাই জীবনের শেষ মুহূর্তেও যদি তাওবা করা যায়, সারাজীবনের কাজা নামাজ মাফ হয়ে যাবে। আসলে নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এমন ভুল ধারণা।
তাওবা করে নেব—এমন চিন্তায় নামাজ ছেড়ে দেওয়া তো চরম নির্বুদ্ধিতা, সময়মতো নামাজ না পড়াও কত কঠিন গুনাহের কাজ জানা থাকলে এই ধারণা কেউ করত না। যথাসময়ে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩)
মনে রাখা জরুরি, আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজের। এই কথাটি নবীজির। (তিরমিজি: ২৬২১) ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ ছেড়ে দিলে ওই ব্যক্তির ওপর আল্লাহর জিম্মাদারি থাকে না বলেও হাদিসে আমরা দেখতে পাই। (মুসনাদে আহমদ: ৫/২৩৮)। এমনকি এক হাদিসে এসেছে, যার ভেতর নামাজ নেই, তার ভেতর দ্বীনের কোনো হিস্যা নেই। (মুসনাদে বাজ্জার: ৮৫৩৯) ওমর (র.) বলতেন, ‘নামাজ ত্যাগকারী নির্ঘাত কাফের’ (বায়হাকি: ১৫৫৯, ৬২৯১)। আলি (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে কাফের’ (বায়হাকি: ৬২৯১)। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে নামাজ পড়ে না সে মুসলমান নয়।’ (বায়হাকি: ৬২৯১)
সুতরাং নামাজ কাজা হলে তা আদায়ের ব্যাপারে গাফলতি কাম্য নয়। এটি সত্য যে, আন্তরিক তাওবার কারণে অন্যের হক ছাড়া সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং আল্লাহ তাআলা তওবাকারীকে ভালোবাসেন। (সুরা বাকারা: ২২২; বুখারি: ২৪৪৯)
এ কারণেই হয়ত জীবনের কাজা নামাজও তওবার মাধ্যমে মাফ হবে কি না—এমন প্রশ্ন শোনা যায়। এ বিষয়ে ইসলামি আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদদের বক্তব্য হলো- ইসলামি শরিয়তে কিছু গুনাহের কাজ এমন রয়েছে, যেগুলোর জন্য শুধু তওবাই যথেষ্ট। আর কিছু কাজ এমন রয়েছে, যেগুলোর জন্য শুধু তওবা যথেষ্ট নয়। বরং কাজাও আদায় করতে হয়। নামাজ হল এ সকল কাজের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই হাদিসে দেখা যায়, রাসুল (স.) নামাজ কাজা হলে তা আদায় করে নিতেন ও অন্যকে আদায় করতে বলতেন। রাসুল (স.) বলেছেন- مَنْ نَسِيَ صَلَاةً فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا، لَا كَفَّارَةَ لَهَا إِلَّا ذَلِكَ ‘কেউ যদি নামাজের কথা ভুলে যায়, সে যেন স্মরণ হওয়া মাত্রই তা আদায় করে নেয়। কেননা, তার কাফফারা একমাত্র সেই নামাজই।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৮৪)
সুতরাং তওবার দ্বারা ছুটে যাওয়া নামাজের কাজা আদায় করা আবশ্যক। নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের কাজা আদায়ে অন্যকে ফতোয়া দিয়ে বিরত রাখাটা চরম ইবাদত বিদ্বেষী মনোভাবের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়। আর নামাজ কাজা থাকলে জীবনের শেষ মুহূর্তে অবশিষ্ট নামাজের ফিদিয়া দেওয়ার ওসিয়ত করতে হবে। নামাজের ফিদিয়া হলো- প্রতিদিনকার কাজা করা বিতিরসহ ছয় ওয়াক্ত নামাজ হিসেব করে প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য পৌনে দুই সের গম বা আটা অথবা এর বাজার মূল্য গরীব মিসকিনকে মালিক বানিয়ে দান করে দিতে হবে। অথবা প্রতি ওয়াক্তের বদলে একজন গরীবকে দুই বেলা তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াতে হবে। যা সদকায়ে ফিতর এর টাকা পরিমাণ হয়। (ফতোয়ায়ে শামি: ২/৭২)
কাজা নামাজ আদায়ের নিয়ম হলো- ছুটে যাওয়া নামাজ পরবর্তী নামাজের আগে পড়ে নিবে। (দ্র: বুখারি: ৫৯৬) অর্থাৎ ফজর ছুটে গেলে ঘুম থেকে উঠার পরপরই অথবা জোহরের আগে, জোহর ছুটে গেলে আসরের আগে, আসর ছুটে গেলে মাগরিবের আগে, মাগরিব ছুটে গেলে এশার আগে এভাবে নামাজ পড়ে নেওয়াই নিয়ম। কারো পাঁচ ওয়াক্তের বেশি কাজা হয়ে গেলে– সেটা কয়েক দিন কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরও হতে পারে-তাহলে তার উচিত কাজা নামাজগুলো একটা অনুমান করে কোন নামাজ কত ওয়াক্ত কাজা হয়েছে তা নির্ধারণ করে নিবে। তারপর তা আদায় করবে। যত দ্রুত এবং যত বেশি সম্ভব এই কাজাগুলো আদায় করতে হবে। প্রতি ওয়াক্তে কয়েক ওয়াক্তের কাজা আদায় করলেও ভালো। এছাড়া সুবিধামতো সময়ে যখন যে নামাজের কাজা আদায়ের সুযোগ হয় আদায় করা যাবে।
উল্লেখ্য, সুন্নত নামাজের কাজা করা যায় না, কেবল ফরজ ও বিতিরের নামাজের কাজা করার সুযোগ আছে। (বুখারি: ৫৯৬; আল ইসতিযকার: ১/৩০২; আদ্দুররুল মুখতার, সাঈদ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা-৬৮; ফতোয়া দারুল উলুম, জাকারিয়া, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা-৩৩২)