dailynobobarta logo
আজ সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০২৩ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | কনভার্টার
  1. অন্যান্য
  2. আইন-আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. খেলাধুলা
  5. গণমাধ্যম
  6. ধর্ম
  7. প্রযুক্তি
  8. বাংলাদেশ
  9. বিনোদন
  10. বিশেষ নিবন্ধ
  11. লাইফস্টাইল
  12. শিক্ষা
  13. শিক্ষাঙ্গন
  14. সারাদেশ
  15. সাহিত্য

১৫ই আগস্টের টেক্সট ও কনটেক্সট

প্রতিবেদক
সোহেল হাসান গালিব
সোমবার, ২৮ আগস্ট ২০২৩ | ১১:৪০ পূর্বাহ্ন
বঙ্গবন্ধু

১৫ই আগস্টের টেক্সট ও কনটেক্সট : বাংলা ভাষায় সর্বাধিক কবিতা লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তারপর সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ। এই তালিকা থেকে আমি বাদ রাখছি রাধা, কৃষ্ণ ও মুহম্মদকে। কারণ সেটার পরিসংখ্যান উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।

বাংলা ভাষায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট কবিতাগুলিও রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এইসব কবিতায় যেমন আছে ভক্তপ্রাণের সৎ ও সরল আবেগ, তেমনি আছে ধূর্ত অকবিদের মুনাফেকি প্রেম। বাঙালি লেখকের আগস্টপনা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকাটা তাই জরুরি। সাহিত্যিক কারণে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে।

‌‘বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা’ নামে বহুবিচিত্র সংকলন প্রকাশিত হয়েছে বিগত দুতিন বছরে। এখনও হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত-গোষ্ঠীগত নানান উদ্যোগে। এসব সংকলনের মানযাচাইয়ে কোনো সম্পাদকীয় ব্যবস্থা যেমন ছিল না, তেমনি আজও নেই এসব নিয়ে বিশেষ কোনো পর্যালোচনা। ফলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে চলেছে কবিতার নামে।

কবিতার কৃষ্টতা বিচারের ক্ষেত্রে আমরা যে ভুলটা করি সে সম্পর্কে আজ ছোট একটা খুতবা দিতে চাই এখানে। কবিদের জন্য এই খুতবা ততটা নয়, যতটা কবিতা-ক্রিটিকদের জন্য, কবিতা-পাঠকদের জন্য।

কন্টেন্ট ও কন্টেক্সটের গরিমা যে কোনো টেক্সকে বাই-ডিফল্ট মহিমান্বিত করে। যেমন ধরেন, আপনি মা-কে নিয়ে একটা গান গাইলেন। অমনি নিখিল-সন্তানেরা হামলে পড়বে, হাইমাউ করে কেঁদে উঠবে। এই কান্নার কারণ এক চিলতে রিচুয়াল, এক চিলতে ব্যক্তিগত স্মৃতি—সব মিলিয়ে ‘মা’ সম্পর্কে করুণ ও আর্দ্র একটি পারসেপশন। এখানে আর্টের ভূমিকা খুব সামান্য। একটা অ্যালার্ম ঘড়ির মতো, সে শুধু ঘুম ভাঙাবে। বাকি কাজ আপনিই করবেন।

ঠিক তেমনি, আপনি যখন নাজি-হলোকাস্টের ওপর কোনো উপন্যাস পড়েন, কিংবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর, আপনার আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ১২ আনা, যদি সে উপন্যাস ১৬ আনা ফালতুও হয়। কারণ এখানে আপনি পরিচালিত হন কনটেক্সট দিয়ে, টেক্সট দিয়ে নয়। কিন্তু যখন একটা তেলাপোকার জন্য, একটা কালকেউটের জন্য আপনার বুকে হাহাকার জাগে, জানবেন অনেক বেশি আপনি মোটিভেটেড বাই আর্ট। উদাহরণ হিশেবে বলতে পারি সেলিম আল দীনের ‘প্রাচ্য’। দেখবেন শেষ পর্যন্ত একটা সাপের জন্য আপনার মায়া তৈরি হবে। যে সাপটি এক নববধূকে দংশন করেছে।

দুর্ভাগ্য এই, আমাদের গুরুগম্ভীর আলোচকবৃন্দ প্রায়শই টেক্সট ফেলে দিয়ে, সগৌরবে, কনটেক্সটের ওপর ফোকাস করেন বেশি, কারণ আর্টের ব্যাখ্যা তাদের জানা নেই। আর জানা থাকলেও, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে ঐ টেক্সট তারা সামলাতে পারেন না। এ ধরনের আলোচনা হাতে পেলেই বুঝবেন, আলোচ্য টেক্সট ফালতু।

এবার একটা উদাহরণ দিয়ে আমার খুতবাকে আরেকটু মজবুতভাবে দাঁড় করাবার কোশেশ করা যাক।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। এই কবিতার কনটেক্সট খুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন কেউ শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না, তখন তিনি বাংলা একাডেমির একটা কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের প্রতি তার ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছিলেন।

অত্যন্ত সৎ ও সরল আবেগে রচিত একটি কবিতা। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্মম সত্য হলো এই, এটা আদতে কোনো কবিতাই নয়। কবিতার মতো শুনতে একটা পার্সোনাল স্টেটমেন্ট বা আর্জি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই লেখা আমাদের ভীষণ আলোড়িত করে, কারণ আমরা ঐতিহাসিক ঐ মুহূর্তের দ্বারা, ঐ নাটকীয় ঘটনার দ্বারা চালিত হই। টেক্সটের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি অত্যন্ত ক্লিশে, বালকোচিত এই রচনা।

#২
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে ভালো দুটি কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান—‘টেলেমেকাস’ ও ‘ইলেক্ট্রার গান’। প্রথম কবিতাটি নিরুদ্দেশ পিতার জন্য পুত্রের অপেক্ষা, দ্বিতীয়টি খুন-হওয়া পিতার জন্য কন্যার শোকপ্রকাশ ও প্রতিশোধের অঙ্গীকার। দুটি কবিতাতেই শেখ মুজিব আক্ষরিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও সর্বাত্মকভাবে উপস্থিত। এটিই কবিতার শক্তি। মিথের শক্তি।

একটা কথা বলে নেয়া দরকার যে, জাতিগত অভীপ্সা নিয়ে একজন পিতার অন্বেষণ শামসুর রহমানের চেতনালোকে সদাই জাগ্রত ছিল। তার প্রমাণ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্যের ‘পিতা’ কবিতাটি। ফলে আমরা বলতে পারি, তিনি আজন্ম টেলেমেকাস। এখন, ‘তিনি নন জন্মদাতা, অথচ তাঁকেই পিতা বলে/ জেনেছি আজন্ম’—এ কথার অর্থ যদি দেশভাগ ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা-উত্তর কালখণ্ডে স্থাপন করে বুঝতে চাই, তাহলে জিনের বাদশার মতো জিন্নাহ সামনে চলে আসতে পারে। বস্তুত এটা তার এমন একটা পজিশন, যার জন্য ব্যক্তি-মুজিব বা ভাসানী বা সোহরোয়ার্দি বা ফজলুল হক কেউই অনিবার্য নয়। তাদেরকে বাদ দিয়েই সে কারণে ‌‘টেলেমেকাস’ কবিতাটা পড়া যেতে পারে।

যেভাবে পড়া যেতে পারে বুদ্ধদেব বসুর ‘কলকাতার ইলেক্‌ট্রা’ নাটকটি। কিংবা ইউজেন ও’নীলের ‘মোর্নিং বিকামস ইলেক্ট্রা’। এসব ক্ষেত্রে সমকালীন কোনো ঘটনা ব্যাখ্যা নয়, সমকালীন দাম্পত্যজীবনের যৌন-জটিলতা, ভঙ্গুরতা ও নিষ্ঠুরতার স্বরূপ উন্মোচনই লেখকের উদ্দেশ্য। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এর পটভূমিতে প্রচ্ছন্ন একটা ছায়াপাত রেখে যায়। কেননা যুদ্ধফেরত সামরিক ব্যক্তির আলেখ্যই দুটি নাটকে লক্ষণীয়। যেন তারা সত্যি ট্রয়যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসা হতভাগ্য আগামেমননের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু শামসুর রাহমানের ‌‘ইলেক্ট্রার গান’ দাঁড়িয়ে আছে সমকালীন ঘটনার ওপর। সেই প্রেক্ষাপট ছাড়া কবিতাটা নিছকই গ্রিক-উপাখ্যানের প্রতিধ্বনি। বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না, এমনকি অর্থহীন প্রলাপ ও বিরক্তিকর বিলাপ মনে হতে পারে। এটি রচিত হয়েছে ৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার প্রেক্ষিতে। আক্ষরিকভাবে তা বঙ্গবন্ধু-কন্যার মনস্তত্ত্বকেই প্রতিফলিত করে। একই সঙ্গে ব্যাখ্যা করে সামগ্রিকভাবে স্বদেশের নাজুক পরিস্থিতি। এখানে কনটেক্সট টেক্সটকে মহিমান্বিত করছে না, বুঝতে সহায়তা করছে মাত্র।

প্রেক্ষাপট এমনভাবে প্রস্তুত ছিল যে কবিকে মিথের বয়ানে সামান্যতম বদল আনতে হয় নি। তিনি ইলেক্ট্রাকে হাজির করেছেন শুধু—এমন এক শহরে যেখানে জুঁই, জবা, বেলি ফোটে। একটুকুই তার ইঙ্গিত—স্বাদেশিকতার। একটা জুতসই মিথ খুঁজে আনাতে যেমন তার সাফল্য, তেমনি বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ না করাতেই এ কবিতার সিদ্ধি।

#৩
গাছ থেকে ফল সরাসরি মাটিতে পড়লেই সবসময় বীজ অঙ্কুরিত হয় না। কিছু বীজের অঙ্কুরোদ্গমের জন্য তাকে পাখির পাকতন্ত্রবাহিত হয়ে মলাকারে নির্গত হতে হয়। এক ধরনের প্রসেসিং আর কি। এটাকে আমরা বলতে চাই ‘বিচ্যুতিপর বিকাশ’। প্রথমে বিচ্যুত হওয়া, তারপরই বিকশিত হয়ে ওঠা। অর্থাৎ, অবিরাম প্রতিসরণ। মানে, মুহুর্মুহু সরে যাওয়া।

কবিতার ক্ষেত্রে বিচ্যুতির দুটি দিক আছে। একটি ভাবগত, অন্যটি বস্তুগত। বস্তুগত-র ক্ষেত্রটি কনটেক্সচুয়াল। এটি আগে ক্লিয়ার করা দরকার। খুব সহজ ও পরিচিত একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক।

জমিদারির ভাগ-বাটোয়ারা শেষে যখন রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরের পাট চুকিয়ে শিলাইদহে নতুন হাট খোলার জন্য মনস্থির করছেন, সেই সময়ে পুরনো বাড়িটির দিকে চেয়ে হুহু করে উঠল তার মন। তিনি গেয়ে উঠলেন : ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লেখ তোমার মনের মন্দিরে…

কিন্তু গানটা ইটকাঠপাথরের গৃহ-লাগি কাতরতা হয়ে রইল না, কোনো রমণীর হৃদকোঠায় প্রবেশের ও প্রতিষ্ঠার মরণপণ বাসনায় রূপান্তরিত হলো। এটাই হলো বস্তুগত বিচ্যুতিপর বিকাশ।

এবারে আসা যাক ভাবগত বিচ্যুতির আলাপে। এই বিচ্যুতির অন্য নাম টেক্সচুয়াল ডেভিয়েশন। যেখানে টেক্সটের ভেতর টেক্সট তৈরি হতে থাকে।

‘কে যাবি পারে নবীর নৌকাতে আয়’—লালনের এই গানে নবী ও নৌকা স্বনামে উপস্থিত। শুনলে মনে হয়, কোনো পরহেজগার মাঝি নদীপাড়ে টুপিমাথায় দাঁড়িয়ে হাটুরে মানুষদের ডাকছে। কিন্তু এই নবী যে নবীমাত্র নয়, স্বয়ং খোদা এবং পরিণামে আত্মরূপে হাজির, তা গানের বিস্তারে ক্রমশ পরিবর্তিত। যে কোনো রূপক বা প্রতীকের কাজ আশলে একটি ভাবের বিচ্যুতি ঘটিয়ে অন্য ভাবের প্রকাশ। শব্দও প্রতীক যেহেতু, অতএব কবিতায় নিদেনপক্ষে তার আভিধানিক অর্থের বিচ্যুতি ঘটাতেই হয়। নইলে সেটা গদ্যই।

#৪
কনটেক্স টেক্সটকে সহযোগিতা যেমন করে, প্রতারিতও করে একইভাবে। ওপরের দৃষ্টান্ত দুটি সে কারণেই টেনে আনা। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে রচনার পরিপ্রেক্ষিত না জানা ভালো। জানলে ভাবরসের আস্বাদনে ব্যাঘাত অবশ্যম্ভাবী। ‌‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি’—একটি শিশুকন্যার অস্ফুট প্রগল্ভতা যে এই প্রেমগানের উৎস, সেটা জানার কোনো দরকারই নেই।

সাহিত্যের অধ্যাপক ও ইতিহাসের কোঁচবক প্রায়শই লেখাকে লেখকের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তার একটি স্থির-নির্দিষ্ট পাঠ তৈরি করতে ব্যাকুল। এমন করতে গিয়ে কখনোবা তারা সত্যি ছুঁয়ে ফেলেন কেঁচো থেকে সাপের ফণা তোলার বিহ্বলতা। কিন্তু যে গান বাতাসে ভেসে বেড়ায়, যে ধন এখন এজমালি হয়ে গেছে, যাকে আর স্থান-কাল-পাত্রের বদান্যতায় বশ করা চলে না, সেখানে তাদের এই পারঙ্গমতায় ধস নামে। হন্তদন্ত খন্তাগুলি যেন তখন অচল পড়ে রয়।

আমরা তো জানি, অনেক ইলিসিট, অ্যামোরাল, পারভার্সিব সিচুয়েশন থেকে প্রেমের পুণ্যকুসুম ফোটে। বোদলেয়ারের ভাষায় ‌‘ক্লেদজ কুসুম’। তাই দুষ্টু লোকেরা বলে : কিছু কথা থাক না গোপন। নাইবা দেখলে বীজবপন।

যে টেক্সট কনটেক্সটকে গৌণ, এমননি হাপিশ করে ফেলতে পারে, সেই হলো স্বয়ম্ভর। ভাবান্তরে, সার্বভৌম।

লেখক : সোহেল হাসান গালিব

মন্তব্য করুন

সর্বশেষ - মানিকগঞ্জ

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com