মা-বাবার কাছে সন্তান অমূল্য সম্পদ। আদর-স্নেহ-মায়া-মমতায় মা-বাবা সন্তানকে বাঁচতে শেখান। একসময় বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলে মা-বাবাও সন্তানের কাছে আশ্রয় চান। কিন্তু সব সন্তান কি তা দিতে পারে কিংবা দেয়? গত ২৬ আগস্ট সমকালে প্রকাশিত খবর, সিরাজগঞ্জের চৌহালীর দুর্গম চরের নির্জন কবরস্থানের পাশে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা বৃদ্ধ মা-বাবাকে ফেলে গেছে তাদের পাঁচ ছেলে। বৃদ্ধ মা-বাবা হয়ে পড়েছেন অসহায়। পরে উপজেলা প্রশাসন ইউএনওর মাধ্যমে তাদের কাছে অর্থ সহযোগিতা পাঠায় এবং তাদের ঘর তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এমন ঘটনা নতুন নয়। এ বছর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুসল্লি ইউনিয়নের নির্জন ভারুয়া বিলে ৮৮ বছরের বৃদ্ধকে চোখ-মুখ ঢেকে রেখে যায় তাঁর ছেলে। একটু পর এসে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ছেলে আর আসেনি। তিন দিন ওখানেই পড়ে ছিলেন তিনি।
ফিরে যাই করোনা মহামারির সময়ের দিকে। করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধ মাকে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে চলে যায় তাঁর ছেলেমেয়ে ও জামাতারা। এমনও অনেক ঘটনা আছে, ভিক্ষাবৃত্তি করে ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন মা-বাবা। বড় হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার বদলে মা-বাবাকে ফেলে সন্তানরা চলে গেছে যে যার মতো। তবে কি শৈশব থেকে মা-বাবা সন্তানদের নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ ও দায়িত্বজ্ঞানের শিক্ষা দিতে পারেননি? নাকি সমাজ-রাষ্ট্র এবং নানা অজানা কারণ সন্তানদের পাষণ্ড ও অমানবিক করে তুলছে?
বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্ব না নিয়ে বোঝা মনে করা, মা-বাবাকে রাস্তা কিংবা কবরস্থানে ফেলে যাওয়াকে অবশ্যই পাষণ্ড ও বর্বর মানুষের কাজ বলব।
এবার একটু অন্য ছক আঁকি। প্রায় দুই দশক ধরে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠিত হচ্ছে। জীবিকার সন্ধান, ভালো চাকরি, আগের চেয়ে উন্নত জীবন, সন্তানদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ চিন্তা ইত্যাদি নানা কারণে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এ কারণে মা-বাবা ও অন্যদের গ্রামে রেখে দুই, তিন বা চার সদস্যের একটি পরিবার শহরে এসে নতুন একটি একক পরিবার গঠন করছে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, পরিবারের পুরুষ যিনি, তিনি একাই আয় করছেন। তাঁর একার আয়ে দুটি সংসার (অর্থাৎ গ্রামে বাস করা মা-বাবা এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গঠিত সংসার) চলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অধিক বাসা ভাড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসা খরচ, সন্তানদের পড়ার খরচ ইত্যাদি ব্যয়ভার পুরুষটি আর কুলিয়ে উঠতে পারেন না। উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত কোনোভাবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হয়তো টিকে থাকছে। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায়, যারা রিকশা চালায়, দিনমজুরের কাজ করে অর্থাৎ কামলা খেটে কিছু টাকা আয় করছে, তাদের অনেকের পক্ষে তিন বেলা খাবার জোগাড় করা কষ্টকর। সে ক্ষেত্রে মা-বাবা ও অন্যদের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন করা হয়তো হয়ে ওঠে না। নয়তো পাঁচ সন্তানের মধ্যে কোনো এক সন্তানের ঘরেও কেন আশ্রয় মেলেনি সেই মা-বাবার?
স্বীকার করছি, অনেক অবস্থাসম্পন্ন, সামর্থ্যবান সন্তানও মা-বাবাকে নিজের সঙ্গে রাখে না কিংবা রাখতে পারে না। উপায় না দেখে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। দিনের পর দিন খোঁজ নেয় না। ভুলে যায় তারা– মা-বাবারও অভিমান হয়, মন খারাপ হয়, রাগ হয়। তারাও কাঁদেন। সেসব সামর্থ্যবানের ক্ষেত্রে বলব, এ শুধু নিজের নির্বুদ্ধিতা ও অমানবিক আচরণ।
বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তা, জঙ্গল, নির্জন কবরস্থানে ফেলে যাওয়ার এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে এবং গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনার অবসান জরুরি। মা-বাবার ভরণপোষণ ও সার্বিক দায়িত্ব নেওয়ার মতো সদিচ্ছা সন্তানের থাকা উচিত। বিবেচনা ও মূল্যবোধ ভেতরে জাগ্রত হওয়া জরুরি। সন্তানের উচিত মা-বাবার প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করা। সন্তানকে আরও সমব্যথী, সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলা প্রবীণদের প্রতি মাসে সন্তোষজনক বয়স্ক ভাতা দেওয়া। একই সঙ্গে প্রতি মাসে প্রবীণরা ঠিকভাবে ভাতা পাচ্ছেন কিনা, তার তদারকি করা। মা-বাবার ভরণপোষণ দিতে অনিচ্ছু এবং দায়িত্বে অবহেলা করা সামর্থ্যবান সন্তানদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।
রিক্তা রিচি: কবি ও সাংবাদিক