হারিয়ে যাওয়ার ২৫ বছর পর বাড়ি ফিরলো মাইদুল! বাবার কাছে খবর ছিল, মায়ের সঙ্গে ঢাকায় এসে দুর্ঘটনায় মারা গেছে ছেলে। কিন্তু ২৫ বছর পর শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সেই ছেলেকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত বাবা আব্দুস সামাদ।
ঘটনা কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের। এলাকাবাসী জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন মতিয়ার রহমান ও মাইদুল ইসলাম নামে দুই ভাই। তাদের একজন নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। শনিবার বেলা ১১টার দিকে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে নিজ বাড়িতে ফেরেন মাইদুল।
শনিবার সকালে দেখা যায়, উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নে গোপালপুর উত্তর সরকারটারী মাঠের পাড় গ্রামের লোক সমাগম ঘটেছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি অটোরিক্সা থেকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে নামলেন মাইদুল ইসলাম। এসময় প্রতিবেশি ও স্বজনরা ফুলের মালা ও মিষ্টি মুখ করিয়ে বরণ করে নেন তাকে।
জানা যায়, ওই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সামাদ ও বানেছা বেগম দম্পতির দুই ছেলে মতিয়ার রহমান (৩৬) এবং মাইদুল ইসলাম (বর্তমান বয়স ৩২)। ১৯৯৭ সালের দিকে তারা দুই ভাই মায়ের সঙ্গে ঢাকা গিয়ে হারিয়ে যান। এরপর থেকে অনেক খুঁজেও তাদের পাওয়া যায়নি। অবশেষে সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যমের কল্যাণে ছোট ছেলে মাইদুল ইসলামকে ফিরে পেয়েছে তার পরিবার।
মাইদুলের বাবা আব্দুস সামাদ বলেন, ‘ওর মা বানেছা বেগমের সঙ্গে পারিবারিক কলহের কারণে তালাক হয়ে যায় প্রায় ২৫-২৬ বছর আগে। পরে বানেছা বেগম দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকা পাড়ি জমায়। সেখানে সে আরেকটি বিয়ে করে। বানেছা দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে সংসার পাতলেও দুই ছেলের ঠাঁই হয় অন্যের বাড়িতে। কিন্তু সে ছেলে দুটোর বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিত না। বলত, বিদেশে যেতে প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অনেক চাপ দেয়ার পর সে স্বীকার করে প্রথমে মাইদুল এবং তার ১০-১৫দিনের মাথায় বড় ছেলে হারিয়ে গেছে।’
আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আজ দীর্ঘ ২৫টি বছর পর আমার ছোট ছেলেকে পেলাম। আল্লাহর কাছে অনেক কান্না করেছি। যেন আমার মৃত্যুর আগে আমার সন্তানদের দেখে যেতে পারি। আজ সেই আশা কিছুটা পূরণ হয়েছে। এখন বড় ছেলের খোঁজ পেলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব।’
বাড়ি ফেরার পর হারিয়ে যাওয়া এবং তার ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দেন মাইদুল। তিনি বলেন, ‘মা প্রথমে আমাদের দু’ভাইকে রংপুর নিয়ে যান। সেখান থেকে ঢাকা। সে মানুষের বাসায় কাজ করত। আমাদেরকে একটি বাসায় রেখেছিল দিনাজপুরের ঠিকানা দিয়ে। যে বাড়িতে রেখেছিল সেই বাড়ির মালিকের টাকা চুরি হয়। সে আমাকে সন্দেহ করে। ভেবেছিল মা অথবা বড় ভাই টাকা দিবে। এজন্য আমাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখে। পরে তার মেয়ে ঘরের দরজা খুলে দেয় আমাকে বের হয়ে যেতে। সারাদিন না খেয়ে ছিলাম। পরে একজন মহিলা আমাকে পেয়ে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা নিয়ে আসেন। সেখানেই বড় হই তাদের সন্তান পরিচয়ে। বড় হয়ে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করি। এরপর সেখানেই বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু হয়।’
মাইদুল বলেন, ‘একদিন ‘আপন ঠিকানা’ নামের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার হারিয়ে যাওয়ার বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর আমার বাবা-মা (সামাদ-বানেছা দম্পতি) আমার সঙ্গে দেখান করেন। সেখান থেকে আমি নিশ্চিত হই তারাই আমার প্রকৃত মা-বাবা। পরে বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়।’
মাইদুল আরও বলেন, ‘কখনো ভাবতেই পারিনি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আবারও দেখা হবে। নিজ গ্রামে ফিরে এসে শৈশবের অনেক স্মৃতি আমার মনে পড়েছে।’
এ সময় স্মৃতিকাতর হয়ে মাইদুল বলেন, ‘বাড়ির পাশের মসজিদের কথা মনে আছে। দাদা সেখানে আজান দিত, আমি ইফতার নিয়ে যেতাম। বাবার সাথে পাশের নদীতে মাছ ধরতে যেতাম এমন অনেক স্মৃতি মনে পড়েছে।’
আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘বড় ইচ্ছে ছিল আমার বড় ভাই আজ আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিবে। কিন্তু সেই ভাইকে আজও পাওয়া যায়নি। এখন আমি নিজে বড় ভাইকে খুঁজে বের করব।’
মাইদুলের স্ত্রী মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমিও আশায় ছিলাম আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে ফিরে পাব। আমার সন্তানরা তার দাদা-দাদীর স্নেহ ভালোবাসা আদর পাবে। আমিও শ্বশুর-শাশুড়ির ভালোবাসা পাব। এটা যে কী আনন্দ, বলে বুঝাতে পারবো না। খুবই খুশি হয়েছি আমার স্বামী তার বাবা-মাকে ফিরে পাওয়ায়।’
মাইদুল ইসলামের চাচা বদিউজ্জামাল বলেন, ‘মাইদুল ও মতিয়ার দুজনে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে প্রায় ২৫ বছর আগে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমরা তাদের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাইদুলকে ফিরে পেলাম। আশা করি কোন একদিন মতিয়ারকেও খুঁজে পাব।’
স্থানীয় বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, ‘আমি দেখেছি মাইদুল ও মতিয়ার ৫-৬ বছর বয়সে ওর মা দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকা চলে যান। কিছু দিন পর শুনি ওরা দুই ভাই হারিয়ে গেছে। প্রায় ২৫ বছর পর ছোট ভাই মাইদুল ফিরে এল মতিয়ারকে পাওয়ার আশায় আছে তার পরিবার।’
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাউছার আহাম্মেদ বলেন, ‘সন্তোষপুর ইউনিয়নে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার খবর জানতে পেয়েছি। সেখানে আব্দুস সামাদ নামে এক বাবার দুই সন্তান হারিয়ে যায়। দীর্ঘ ২৫ বছর পর এক ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে। মাইদুল যদি চায় তাহলে সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় আনাসহ পরিবারটিকে সহযোগিতা করা হবে।’