আদিল সরকার, ইবি : রুম নং ১৩৬, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আবাসিক হল ‘লালন শাহ’। পরিচিত গণরুম হিসেবে। পছন্দানুক্রমে নবীনদের রুমে তুলেন আগের বছরের সিনিয়ররা। কিছুদিনেই হয়ে উঠে তাদের মধ্যে বুঝাপড়া। গড়পরতা হলেই শুরু হয় নির্যাতন। যা চলে ‘ম্যানার ট্রেইন’ এর নামের অন্তরালে। প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের পরিচয়। দেয়া হয় মুখ না খোলার ট্রিটমেন্টও। একই চিত্র বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হলের অন্যান্য গণরুমগুলোর।
তবে বর্তমানের চিত্র মোড় নিয়েছে ভিন্নপথে। নির্যাতনের একপর্যায়ে উলঙ্গ করা হচ্ছে ভুক্তভোগীকে। পরে এমন অবস্থাতেই নেয়া হয় ছবি কিংবা ভিডিও। সাথে জোর করে বিভিন্ন জিনিসের সাথে করানো হয় যৌনাচার। অন্যথায় মাস্টারবেশনসহ নানান কার্যক্রম। যার বর্ণণা দিতে গিয়েও চুপসে যাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ফলে নিজেকে ঘটনা থেকে আড়াল করে নিচ্ছেন কেউ কেউ।
ছেলে কিংবা মেয়ে, নগ্ন করে এভাবেই রাতভর নেয়া হয় পৈশাচিক আনন্দ। একের পর এক ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা ঘটেই চলছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যেন তা পরিণত হয়েছে এক অভিন্ন ট্রেন্ডে। প্রতিটি ঘটনাতেই মাত্রা দিচ্ছে আতঙ্ক ও ভয়াবহতা। সর্বশেষ গত বুধবার নবীন এক শিক্ষার্থীকে উলঙ্গ করে রাতভর নির্যাতন করেছে একধিক সিনিয়র। এনিয়ে তৃতীয়বারের মতো র্যাগিং এর নামে এমন বিবস্ত্রতার চিত্র ভেসে উঠেছে ক্যাম্পাসে। তবে অদৃশ্য চাপে অভিযোগ দিতে নারাজ হচ্ছেন ভুক্তভোগী। এর আগে অভিযোগপত্র জমা দিলেও তা চাপের কারণে প্রত্যাক্ষানও করেছেন এক শিক্ষার্থী। এদিকে প্রতিটি ঘটনার পেছনেই উঠে আসছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম। নিজেরাই সমাধান করে প্রশাসনের কাছে অভিযুক্তদের যেতে মানা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে নেতাদের বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত র্যাগিং এর নামে এমন ঘটনায় আতঙ্কে নবীন শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা।
জানা যায়, গত ৭ ফেব্রæয়ারি রাতভর লালন শাহ হলের গণরুমে (১৩৬ নং) নবীন এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেন একই রুমে অবস্থান করা সিনিয়র চার শিক্ষার্থী। চড়-থাপ্পড়ের একপর্যায়ে ভুক্তভোগীকে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করতে করতে বাধ্য করা হয়। পরে ওই ছাত্রকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে ‘কাকতাড়–য়া’ বানিয়ে রাখেন অভিযুক্তরা। এছাড়া উলঙ্গ অবস্থায় পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করা হয় তাকে। পরে নাকে খত (কোন অঙ্গিকারে মাটিতে দাগ দিয়ে নাক দিয়ে সেই দাগ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া) দিয়ে ভোর চারটায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে অনুসন্ধানে জানা যায়, গত পাচঁ মাস ধরেই তার সাথে এমন অশ্লীল কর্মকান্ডের ঘটনা চলে আসছে বলে নিশ্চিত করেন ভুক্তভোগী। সাথে নির্যাতনের বিষয়ে কাউকে জানালে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে বলে হুমকি দেন অভিযুক্তরা।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সক্রীয় কর্মী ও সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী। তবে ঘটনায় নিজেদের কোন প্ররোচনা নেই এবং সংগঠনের কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন সম্পাদক। তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিও করেছেন তিনি। এদিকে সাধারণ সম্পাদক নিজে ওই হলে অবস্থান করেন বলে জানা গেছে। এর আগেও তার হলে এমন বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। পরে ওই ভুক্তভোগী ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। তবে শাখা ছাত্রলীগ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতারা তাকে ডেকে কথা বলার পর অভিযোগপত্র তুলে নেয় ভুক্তভোগী। এ ঘটনাতেও সম্পাদকের অনুসারী দুই কর্মী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্র। পরে বিষয়টি নিয়ে র্যাগিং প্রতিরোধ সেল থেকেও কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
এদিকে সম্প্রতি র্যাগিংয়ের ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে ক্যাম্পাসে সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট হল। তদন্তের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরতরা।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী প্রতিবেদককে বলেন, ‘র্যাগিং কোনভাবেই কাম্য নয়। আমি চাই এসব ঘটনার বিচার হোক। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।’ প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশের পর আমরা র্যাগিং নিয়ে শক্ত অবস্থানে আছি।’ এদিকে ঘটনায় নিজের নিরাপত্তার জন্য অভিযুক্তদের বিচার চাইছেন না ভুক্তভোগী। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপের কথাও জানাতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে গত বছরের ১১ ও ১২ ফেব্রæয়ারি ফুলপরী খাতুন নামের এক নবীন ছাত্রীকেও র্যাগিংয়ের নামে নগ্ন করে রাতভর নির্যাতন করা হয়। একই সাথে ভিডিও করে রাখা হয় তার সেই বিবস্ত্রতার। ঘটনা নিয়ে সময়ের আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। পরে ঘটনায় জড়িত শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতিসহ চার কর্মীকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এর আগে সংগঠন থেকেও তাদের বহিষ্কার করে শাখ ছাত্রলীগ। এছাড়াও গতবছর নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের দায়ে একই বিভাগের ৫ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।