পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বায়জিদ আহমেদ খানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই এলাকার (পিরোজপুর-৩ আসন) স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজ এবং তার তিন ভাই মিলে এমন পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বায়জিদ। এমপির ভাইদের মধ্যে একজন বর্তমানে পুলিশ সুপার আর বাকি দুজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নিজেই প্রকাশ্যে এনেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান বায়জিদ আহমেদ। শুধু তাই নয়, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা চেয়ে মঠবাড়িয়া থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ উপলক্ষে গত ৪ জুলাই (বৃহস্পতিবার) মঠবাড়িয়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এতে জেলার সব উপজেলা চেয়ারম্যান, ২০ থেকে ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সাবেক সংসদ সদস্যসহ কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বায়জিদ আহমেদ খান দাবি করেন, ‘ঈদুল আজহার রাতে মঠবাড়িয়ার আমগাছিয়ায় নিজ বাড়িতে একত্রিত হয়ে পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র এমপি শামীম শাহনেওয়াজ পরিবারের চার ভাই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন।’
বায়জিদ বলেন, ‘চার ভাই এই ঈদুল আজহার রাতে বাড়িতে একত্রিত হয়ে গোপন বৈঠক করেছেন দু-একজন আত্মীয়স্বজন নিয়ে। সেখানে তারা আলোচনা করেন, যেহেতু মঠবাড়িয়ার মানুষ আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, আমরা কী করতে পারি … সামনের দিনেও জনগণ আমাদের প্রত্যাখ্যান করবে…তাহলে বায়জিদ আহমেদ খানকে সরিয়ে দিতে হবে… তাড়িয়ে দিতে হবে—এ ধরনের পৈশাচিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে হত্যা পরিকল্পনার মতো জঘন্য কার্য করেছেন। এমপি শামীম শাহনেওয়াজ এবং দুর্নীতিবাজ এসপি মিটিংয়ে বলেছেন, বায়জিদকে ফেলে দিতে হবে।’
বক্তব্যে বায়জিদ খান জানান, বিষয়টি তিনি পরবর্তী সময়ে স্থানীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন এবং প্রমাণ হিসেবে ওই হত্যা পরিকল্পনার মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন—এমন এক ব্যক্তির ভিডিও সাক্ষাৎকারও তাদের দেখিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। পরে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের পরামর্শে তিনি মঠবাড়িয়া থানায় এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরিও দাখিল করেছেন।
বায়জিদ আহমেদ খান আরও দাবি করেন, মঠবাড়িয়ার এমপি পরিবারের চার ভাই-ই নানা অপকর্মে জড়িত। এমপি পরিবার হঠাৎ করেই বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক বনে গেছে। গত ১০ বছরে মঠবাড়িয়ার বিভিন্ন নির্বাচনে এই পরিবার ১০০ থেকে দেড়শ কোটি টাকা খরচ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বায়জিদ আহমেদ খান আরও দাবি করেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য পরিবারের ছোট ভাই আশরাফুর রহমান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মঠবাড়িয়ায় নির্বাচন করে হেরেছিলেন। সে সময় এই এসপি সরকারি চাকরিজীবী হয়েও নানা উপায়ে ভাইয়ের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণা ও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তিনি এমপি পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করেন। বায়জিদ আহমেদ খানের এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মঠবাড়িয়া উপজেলাসহ গোটা পিরোজপুর জেলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। চায়ের দোকান থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনের সর্বত্র বিষয়টি আলোচিত হয়।
গত উপজেলা নির্বাচনে মঠবাড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র এমপি শামীম শাহনেওয়াজের সেজো ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন বায়জিদ আহমেদ খান। এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজীকে পরাজিত করেন শামীম শাহনেওয়াজ। তার আরেক ভাই আশরাফুর রহমানও মঠবাড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন।
পরপর দুটি নির্বাচন কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিরোধের জেরে মঠবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগের মধ্যে চরম বিভক্তি তৈরি হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনের প্রচারণার সময় দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নির্বাচনে বায়জিদ আহমদ খান জয়ী হওয়ার পরও পরাজিত প্রার্থী রিয়াজউদ্দীন আহমেদের সমর্থকরা সংঘাতে জড়িয়েছেন। সেই রেশ কাটার আগেই হত্যা পরিকল্পনার মতো গুরুতর অভিযোগ আনলেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
যোগাযোগ করা হলে মঠবাড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান বায়জিদ আহমেদ খান জানান, কোনোরকম রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল কিংবা বিষোদ্গারের জন্য নয়, তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই তিনি ওই বক্তব্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাকে হত্যা করার জন্য এমপি ও তার ভাইয়েরা তাদের এক চাচাতো ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ওই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পিরোজপুর কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি থাকা আসামিদের জামিনে বের করে তাদের মাধ্যমে মিশন সফল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’
বায়জিদ খান আরও দাবি করেন, ‘অবৈধ উপায়ে এসপি কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে তা মঠবাড়িয়ায় তার ভাইদের রাজনীতির কাজে ব্যবহার করছেন। মঠবাড়িয়া থানায় ও উপজেলার বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে এসপি ফোন করে নানাভাবে তার ভাইদের রাজনৈতিক কাজে প্রভাব বিস্তার করেন।’
তিনি বলেন, ‘মঠবাড়িয়ায় একটি পারিবারিক সিন্ডিকেটের আধিপত্য তৈরি করা হয়েছে। তাদের কাছে সবাই জিম্মি। তাদের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। এখানে কাউকেই নির্বাচন করতে দিত না। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাদের বাহিনী পাঠিয়ে মারধরের হুমকি দেওয়া হতো। ভোটারদের ভোট দিতে দেওয়া হতো না। কিন্তু এবার তারা এটা পারেননি। যে কারণে জনগণের রায় তাদের বিপক্ষে গেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আমাকে বেছে নিয়েছেন। তাই তারা আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন। আমি ভীতসন্ত্রস্ত, জীবন নিয়ে আতঙ্কে আছি।’
বায়জিদ আহমেদ আরও জানান, ‘হত্যার জন্য শাহাদাত নামের ডাকাতকে জামিনে বের করা হয়েছে। শাহাদাতের স্ত্রী আমাকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এ ছাড়া পরিকল্পনার সময় তাদের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় সেখানে ছিলেন। তিনিও আমাকে বিষয়টি অবহিত করেছেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মঠবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আশিকুজ্জামান বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সাধারণ ডায়েরির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। ঊর্ধ্বতন পর্যায়েও বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমরা উনাকে (উপজেলা চেয়ারম্যান বায়জিদ আহমেদ) বলেছি, যে কোনো প্রয়োজনে যেন আমার বা আমাদের ঊর্ধ্বতনদের অবগত করেন। আমরা তার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
হত্যা পরিকল্পনার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এমন কোনো পরিকল্পনা করার প্রশ্নই আসে না।’ ডাকাত শাহাদাতকে জামিনে বের করে আনার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে চিনি না।’