সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল চেয়ে ছাত্রদের একাংশ আন্দোলন শুরু করেছিল বেশ আগে থেকেই। আন্দোলনটা প্রথমদিকে খুব লোকপ্রিয় হয়নি- দক্ষিণপন্থী কিছুসংখ্যক ছাত্র কর্মসূচিতে অংশ নিতো, কিছুক্ষণ বিক্ষোভ করে আবার চুপচাপ।
২০১৮ সালে কোটাবিরোধী এই আন্দোলনটা বেশ জমজমাট হয়ে গেল এবং আন্দোলনের ঢেউ ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে গেল। আন্দোলনকারীরা প্রথমদিকে কোটা বাতিলের কথা বললেও পড়ে বলতে শুরু করলো কোটা সংস্কারের কথা।
কেননা আন্দোলন চলমান অবস্থাতেই সমাজের নানা অংশের মানুষের কথা শুনে ওদের উপলব্ধি হয়েছিল যে না, সমাজে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অংশের সমতায় নিয়ে আসার জন্যে কোটার প্রয়োজন আছে এবং সব কোটা বাতিলের দাবি করলে ওদের প্রতি লোকের সমর্থন থাকবে না।
সেই দফায় ওদের সাথে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা ছাড়াও অনেক সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সেইবারও আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে কেবল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ যখন তাদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে সেই হামলার পর।
ছাত্রলীগ যখন হামলা করে সেই হামলাটা কেউ পছন্দ করেনি এবং দেখা গেল যে ছেলেমেয়েরা নিজেদের ক্যাম্পাস রক্ষার তাগিদেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ঘোষণায় সব ধরনের কোটা বাতিল করে দিলেন।
হাইকোর্ট ডিভিশন যখন একটা রিট মামলায় কোটা বাতিলের আদেশটি অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত বলে বেআইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন, তারপর ছেলেমেয়েরা ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন শুরু করে।
এই দফায় আন্দোলনের প্রথম থেকেই শাহবাগে এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে আন্দোলনের সমর্থকদের ভালো জমায়েত ছিল এবং ১৬ জুলাইয়ের ২০২৪-এর আগে পর্যন্ত পুরো আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল ছিল বরাবরই।
…মানুষের মনে এখন একটাই কথা ছাত্ররা মারা গেল কেন? ছাত্রদের ওপর গুলি চললো কেন?
পুলিশও এর আগে পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সেই রকম কোনো শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, ওদের কখনো ছত্রভঙ্গ করেনি, ওদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি। এমনকি বঙ্গভবনের সামনেও ওরা যখন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে গুলিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে গেছে, পুলিশ ওদের বাধা দেয়নি।
উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় যখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণা দেয় এবং আন্দোলন প্রতিহত করার জন্যে ক্যাম্পাসে শক্তি প্রদর্শন শুরু করে। আর ১৬ জুলাইয়ের ২০২৪ তারিখে তো সারা দেশে আন্দোলনকারী, পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে ছয়জন তরুণ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে শত শত।
কেবল ছাত্ররা নয়, বাংলাদেশের কোনো মানুষই সন্ত্রাস পছন্দ করে না। এটা ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং অসংখ্যবার দেখা গেছে যে এই অনিবার্য বাস্তব কথাটি ক্ষমতায় গেলে সব রাজনৈতিক দলই বেমালুম ভুলে যায় এবং আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করতে গিয়ে আন্দোলনকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করে দেয়।
ছাত্ররা কোটা নিয়ে যে আন্দোলনটি করছিল সেই আন্দোলনটি আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা, ওদের দাবি মেনে নেওয়া আদৌ জরুরি কিনা বা মেনে নিলেও কতটুকু মানা উচিত সেইসব প্রশ্ন এখন গুরুত্বের বিচারে পেছনে চলে গেছে। মানুষের মনে এখন একটাই কথা ছাত্ররা মারা গেল কেন? ছাত্রদের ওপর গুলি চললো কেন?
সেইসাথে সরকারের বিরুদ্ধে এর আগে জমে থাকা ক্রোধ-হতাশা-বিরক্তি-ক্ষোভ সবকিছু যুক্ত হয়ে আন্দোলনটি একটি প্রকৃত গণআন্দোলনে রূপ নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এখন যেহেতু কয়েকজনের মৃত্যু ঘটেছে—রাজনীতির মাঠের ভাষায় লাশ পড়েছে—সাধারণ হিসাবে এখন আন্দোলন তুঙ্গে উঠে যাওয়ার কথা।
অথচ এরকমটি হওয়ার কথা ছিল না। আন্দোলনকারীদের যে দাবি, সেই দাবি সরকার অস্বীকার করে না, আন্দোলনকারীরা যা চায় সরকারও মোটামুটি তাই-ই চায়।
এইখানে ছাত্রদের আন্দোলনের পেছন থেকে একটি সুসংগঠিত বুদ্ধিমান শক্তি কৌশলে উত্তেজনাটা তৈরি করেছে। চীন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? আপনাদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম’; এই কথাটি নির্দোষ, এর মধ্যে আপত্তিকর কিছু নেই।
…এখন এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে মাঠে সরকারপন্থী ছাত্ররা আর আন্দোলনকারী ছাত্ররা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে।
একটি অদৃশ্য চক্র ছাত্রদের মধ্যে ছড়ালো যে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাজাকার বলেছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। একে ওরা ব্যবহার করেছে উসকানি তৈরি করতে। শুধু কথাটি ছড়িয়েই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। সেদিন গভীর রাতে ওরা ঢাকা শহরের কয়েকটা জায়গা থেকে মিছিল বের করলো যেখানে ছাত্ররা শ্লোগান দিয়েছে, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’।
পরে ওরা শ্লোগানটা সংশোধন করেছে কিন্তু প্রথম থেকে এই শ্লোগানটাই দিয়ে এসেছে। এই শ্লোগানের ফলে সর্বত্র উত্তেজনা আরও ছড়িয়ে পড়ে। কেননা রাজাকার কথাটি জঘন্য আর কিছু ছাত্ররা কিনা এই শ্লোগান দিয়ে মিছিল করবে?
এর প্রতিবাদ করতেই ছাত্রলীগ মাঠে মিছিল করতে নেমেছে, সমাজের অন্য অনেক লোক বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। পেছন থেকে যে বুদ্ধিমান শক্তিটি কলকাঠি নাড়ছিল ওদের পরিকল্পনা সফল হতে দেখা গেল।
এখন এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে মাঠে সরকারপন্থী ছাত্ররা আর আন্দোলনকারী ছাত্ররা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। আন্দোলনকারীদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও যুক্ত আছে জামায়াতি ছাত্র সংগঠন, বিএনপির ছাত্রদল, মওলানা ভাসানিপন্থী-সাবেক চীনপন্থী ছোট ছোট সংগঠনের ছেলেমেয়েরা—আর আছে অসংখ্য সাধারণ তরুণ-তরুণী যারা এমনিতে হয়তো এই আন্দোলনে যোগ দিতো না, কিন্তু ১৬ জুলাই ২০২৪ থেকে এরা মাঠে সক্রিয় ছিল।
এই যে শেষ অংশটির কথা বললাম, সাধারণ তরুণ-তরুণীরা—এরা কেবল কোটার দাবিতে মাঠে নামেনি। ওর নেমেছে সরকারের ছাত্র সংগঠনের শক্তি প্রয়োগ করার প্রতিবাদে। আর তার পেছনে সাধারণভাবে কাজ করেছে দেশে গণতন্ত্রহীনতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শোষণ, দুর্নীতি—এইরকম নানা ধরনের ব্যর্থতার কারণে সরকারের প্রতি তরুণদের বিদ্যমান ক্ষোভ।
এইরকম আন্দোলনের সাথে অনেক সময় মানুষের মনের সমন্বিত ক্রোধ অন্ধ গোঁ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং সেই পর্যায়ে সরকারের পতন ছাড়া আর কোনো কিছুতেই আন্দোলন থামে না।
যারাই পেছন থেকে এই আন্দোলনের উসকানি দিচ্ছে, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করছে এবং কলকাঠি নাড়ছে, ওদের লক্ষ্য হচ্ছে—আন্দোলনকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যখন ক্ষোভে মানুষ অন্ধ হয়ে সড়কে নেমে আসছে আর ওরা সরকার পতনের ডাক দেবে। এর ফলে দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হবে তাতে কি কারও মঙ্গল হবে?
এখন সরকারের উচিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে, তাদের দাবি-দাওয়া শুনে সমঝোতার দিকে যাওয়া, যে ছয়জন তরুণের প্রাণ গেল তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো। এই জরুরি কাজটা করতে যদি সরকার দেরি করে তবে জনগণের আস্থা আরও কমে যাবে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট